শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ, ১৪৩১
মো: মাকসুদ উল্যাহ।।
সেদিন একজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি কিছুদিন আগে সন্ধ্যায় একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেখেন, মোট রোগী ১৪০ জন। ফলে চিকিৎসকের কাছে সন্তোষজনক সময় পাননি।
তিনি জানতে চান, এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কী?
আমি দেখছি, একটু সচেতন হলে এ অবস্থা থেকে রোগীরা নিজেরাই মুক্তি পেতে পারেন। রোগীরা নিজেরাই এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এর চাবি রোগীপক্ষেরই হাতে। যেহেতু রোগীরা নিজেরা এ সমস্যা সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু সমাধানও তাদের হাতেই।
যে ডাক্তার প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ জন রোগী দেখেন, রোগীরা তাকে দেখানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এটি একটি আবেগি বিষয়! এই আবেগের সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই।
এমনকি ওই ডাক্তারের ভিজিট ৫০০ টাকা হলে তাকে দেখানোর জন্য তার পিওনকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে হলেও দেখাতে চেষ্টা করেন! এতে করে ওই ডাক্তার রোগীদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। ঠিকমতো সময় দিতে হলে রোগীকে ৩০ দিন পরে আসতে বলা হয়! তত দিনে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। রোগীরা এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়লে তো এমন হবেই, তাই না?
এ ক্ষেত্রে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমার রোগীর তো জরুরি অবস্থা, ৩০ দিন পরে কেন সিরিয়াল হবে। আজই হতে হবে। এখনই হতে হবে!’ এটাকে তারা ডাক্তারের তরফ থেকে অন্যায় বলে মনে করেন!
কিন্তু ৩০ দিন পর সিরিয়াল পাওয়াটা ডাক্তারের তরফ থেকে অন্যায় নয়। বরং এ সমস্যা রোগীদের নিজেদের দিক থেকে সৃষ্ট। তারা যখন জানতে পারেন, অমুক ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর ভিড় বেশি, সেই ডাক্তারের কাছে তারা না গেলেই তো সমাধান হয়ে গেল। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার মানে এই নয়, তিনি সবচাইতে বিজ্ঞ ডাক্তার। রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক মানেই সেরা ডাক্তার নন।
অনেকে মনে করেন, চট্টগ্রামের ডাক্তারের চেয়ে ঢাকার ডাক্তার বেশি অভিজ্ঞ! এ ধারণাও ভিত্তিহীন। দেশের সব এলাকার ডাক্তারেরা একই বই পড়ে ডাক্তারি করেন। তারা ঘুরেফিরে একই উৎস থেকে ডাক্তারি শেখেন। যিনি আজ ঢাকা মেডিক্যালে কর্মরত আছেন, তিনিই আগামীকাল ফরিদপুর বা কুমিল্লা বা চট্টগ্রাম মেডিক্যালে বদলি হন। আবার আজ যিনি নোয়াখালী মেডিক্যালে কর্মরত আছেন, আগামীকাল তিনি ঢাকা মেডিক্যালে বদলি হতে পারেন।
অন্য দিকে একই রকম যোগ্যতার এবং সচ্চরিত্রবান, সদাচারী ও সদালাপী অন্য অনেক ডাক্তার তাদের চেম্বারে খালি বসে থাকেন বা বড়জোর পাঁচ-ছয়জন রোগী দেখেন! তারা সময় দিয়ে রোগী দেখার অপেক্ষায় বসে থাকেন। রোগীরা মনে করেন, এই ডাক্তারের চেম্বারে যেহেতু রোগী কম, সেহেতু তিনি কম যোগ্য; কম দক্ষ। কিন্তু এটা মারাত্মক ভুল ধারণা। অনেক সময় (সব ক্ষেত্রে নয়) দেখা যায়, যে ডাক্তার সততা বজায় রেখে ডাক্তারি করতে চান, সে ডাক্তারের কাছে রোগীকে যেতে দেয়া হয় না। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালেরা বলে, ‘উনি ডাক্তার হিসেবে ভালো না’। আর যে ডাক্তার অন্যায়ের সাথে আপস করেন, মধ্যসত্ত্বভোগীরা বা দালালেরা রোগীদের সেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।
ফলে কিছু ব্যতিক্রমসহ সৎ ডাক্তারের চেম্বারে রোগী থাকে হাতে গোনা কয়েকজন। অতএব রোগীর সংখ্যা কম মানেই ডাক্তার অযোগ্য, এ কথা বলার সুযোগ নেই।
অন্য দিকে ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর সংখ্যা বেশি মানেই সেরা ডাক্তার নন। বরং অনেক সময় দেখা যায়, বেশি রোগী পাওয়ার জন্য কেউ কেউ বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নেন।
উপজেলায় ডাক্তারদের কেউ কেউ বিভিন্ন ছুতায় বাজারের সব ফার্মেসি ব্যবসায়ীর কাছে মিষ্টি পাঠান! ফলে ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা অন্ধভাবে তার কাছে রোগী পাঠান। অনেকে আবার এলাকার যুবকদের হোটেলে নিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ালে যুবকেরা তার প্রশংসা করতে থাকলে লোকেরা মনে কপ্রণ তিনি সেরা ডাক্তার!
বড় শহরের ক্ষেত্রে কূটকৌশল একটু ভিন্ন হতে পারে। সংশ্লিষ্ট প্রাইভেট হাসপাতালের কর্মচারীদের কাছে একটু ছোট হলেই হয়।
আমি আমার কোনো আত্মীয় স্বজনকে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হলে যে ডাক্তারের চেম্বারে রোগী কম সেই ডাক্তারকে দেখাই।
আমার মাকে গিরারোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর জন্য পূর্ণ অধ্যাপকের কাছে নেইনি। বরং নিয়েছি সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের ডাক্তারের কাছে। মাছি মারতে কামান দাগানো লাগে না। আমি এখন পর্যন্ত দুইবার পায়ে আঘাত পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য আমি অর্থোপেডিকের কোনো বিভাগীয় প্রধান বা পূর্ণ অধ্যাপককে দেখানোর জন্য উঠেপড়ে লাগিনি। বরং তুলনামূলকভাবে কমবয়সী অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েছি।
একসময় একজন ন্যায়পরায়ণ বিশেষজ্ঞকে বলতে শুনেছি, ‘মেডিক্যাল অফিসার যে রোগ সহজে নির্ণয় করতে পারেন না, সেই রোগ পূর্ণ অধ্যাপককেও নির্ণয় করতে হিমশিম খেতে হয়’।
লেখক : চিকিৎসক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।